প্রাচীন রীতি মেনে আজও মশাল জ্বালিয়ে পূজিতা হন মানিকোড়া কালী তথা ডাকাত কালী। ডাকাতদের হাতে পূজিতা দেবী এখন মানিকোড়া কালী নামে পরিচিত। শোনা যায় দেশ ভাগের আগে প্রায় ৩০০ বছর আগে রাতের অন্ধকারে পুনর্ভবা নদী পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে একদল ডাকাত জঙ্গলে ঘেরা মানিকোড়ায় দেবীর পুজো দিতে আসত। এই দেবী জাগ্রত বলে দাবি স্থানীয়দের। সূর্য ওঠার আগেই পুজো দিয়ে আবার নিজেদের ডেরায় ফিরে যেত ডাকাতরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুজো উদ্যোক্তাদের পরিবর্তন ঘটেছে। ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় এক জমিদার জঙ্গলে ঘেরা এই পরিত্যক্ত পুজোর বেদি খুঁজে পান। এরপর থেকে বংশপরম্পরায় জমিদারদের উদ্যোগে এই পুজো হতো। আগে পাঁঠা বলির সময় শেকল দিয়ে বাঁধা থাকত দেবীমূর্তি। তবে এখন আর শেকল বাঁধা হয় না। তবে দেবীর চক্ষুদানের সময় কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় মন্দিরের সদর দরজা।
কথিত রয়েছে, চক্ষুদানের সময় নাকি দেবীমূর্তি দুলতে থাকে। তাই আগে শেকল দিয়ে বাঁধা হতো প্রতিমা। এখন আর সেই নিয়ম নেই। এখন শুধু কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। ভক্তদের কাছে জাগ্রত মালদহের হবিবপুর ব্লকের মানিকোড়া ডাকাত কালী। পুজোকে ঘিরে সাতদিন ব্যাপী চলে মেলা, গানের আসর। মালদহের হবিবপুরের মানিকোড়া গ্রামের এই কালী পুজোকে ঘিরে রয়েছে নানান গল্প। সেখানে গেলেই শোনা স্থানীয়দের মুখে এই সব গল্প পুজোর কাহিনী। এই পুজো ডাকাত দলের হাত ধরেই সূচনা। অবিভক্ত বাংলায় (বর্তমানে বাংলাদেশ) থেকে ঘন জঙ্গলে ডাকাতেরা পুজো শুরু করেছিলেন এখানে। কালী পুজোর রাতে ঘন জঙ্গলে মশাল জ্বালিয়ে পুজো করতো রাতভোর। তারপর প্রতিমা বিসর্জন করে চলে যেত ডাকাত দল। ডাকাতেরা পুজো বন্ধ করলে স্থানীয় জমিদার সেই কালী পুজো করে আসছে দীর্ঘদিন। তারপর স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাঁধে পুজোর দায়িত্ব তুলে দেন জমিদার। বর্তমানে মানিকোড়া গ্রামের বাসিন্দারা মিলিত হয়ে এই কালী পুজো করছেন। একসময়ের ডাকাত কালী এখন সার্বজনীন কালী পুজো হিসাবেই পরিচিত।
পৌরাণিক মতে, একবার মায়ের মন্দিরের পাশ দিয়ে এক শাঁখারি শাঁখা বিক্রি করতে যাচ্ছিল। সেই সময় এক অল্প বয়সী যুবতী তার কাছ থেকে শাঁখা নিয়ে হাতে পড়ে। তখন শাঁখারি তার কাছ থেকে শাঁখার দাম চায়। উত্তরে যুবতী বলে তার বাবা দাম মিটিয়ে দেবে। কিন্তু কোথায় তার বাবা ? এদিক ওদিক মুখ ঘোরাতেই দেখে সেই যুবতী নেই। ঠিক সেই সময় উল্টো দিক থেকে মন্দিরের সেবায়েত (কালি বাবা নামে পরিচিত) আসছিলেন। তখন শাঁকারি তাকে বলে যে তার মেয়ে শাঁখা পরেছে তার দাম দিতে। শুনে সেবায়েত অবাক হয়ে বলে যে তার কোন মেয়ে নেই। তাই শাঁখা পড়ার প্রশ্নই উঠেনা। তখন সেবায়েতের দৃষ্টি যায় মন্দিরের পাশে পুকুরের দিকে। দেখে জল থেকে দুটি হাত উঠে আছে। সেই দুই হাতে শাঁখারির পড়ানো শাঁখা দেখা যাচ্ছে। সেবায়েতের বুঝতে দেরি হয়না যে স্বয়ং দেবী মা কালীই সেই শাঁখা পড়েছে।
এদিকে মানিকোড়া ডাকাত কালী ভক্তদের কাছে খুবই জাগ্রত। প্রতিবছর এই কালীপুজোয় দুই থেকে তিন হাজার ছাগ বলি হয়ে থাকে। শুধুমাত্র মালদহ জেলা নয় বর্তমানে রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে থেকে বহু ভক্তের সমাগম ঘটে এই কালীপুজোয়। বর্তমানে কালীপুজোকে ঘিরে এক বিশাল মেলার আয়োজন করে থাকেন গ্রামের বাসিন্দারা। দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এই কালীপুজো ও মেলা দেখতে আসেন। সাত দিন ব্যাপী চলে কালীপুজোর মেলা। জাগ্রত এই মায়ের পুজো শুধুমাত্র কালি পুজোয় নয় সারা বছর মঙ্গল ও শনিবার হয়ে থাকে। ভক্তদেরও ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। ডাকাতদের হাত ধরে পুজোর সূচনা। তবে ঠিক কতো প্রাচীন এই কালীপুজো তা জানা নেই স্থানীয়দের। শুধুমাত্র লোকমুখেই প্রচলিত রয়েছে ডাকাতদের হাত ধরেই শুরু পুজো। সেই পুজো জমিদার বাড়ির হাত ঘুরে বর্তমানে সার্বজনীন।